বাংলাদেশে আজ (১৬ আগষ্ট ২০২৫) প্রকাশিত প্রধান প্রধান সংবাদগুলোর বিশ্লেষণ

 সমকালের প্রধান খবর: '৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে বাপেক্সকে'

গ্যাসকূপ খনন সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক মামলায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে প্রাথমিকভাবে আজারবাইজানের কোম্পানি সকারকে ৫২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। ২০১৭ সালে ৩৯৯ কোটি টাকার একটি চুক্তি অনুযায়ী সকার তিনটি গ্যাসকূপ খনন করার কথা ছিল, কিন্তু চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ এনে তারা সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে (এসআইএসি) মামলা করে এবং আংশিক রায় তাদের পক্ষে যায়। 

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাপেক্সের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনায় দুর্বলতার কারণেই এই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। মামলার চূড়ান্ত রায় এলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। অবাক করার বিষয় হলো, সকার যে কূপে খনন কাজ চালিয়েছিল সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি, এবং তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। 

এই ঘটনাটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রধান শিরোনাম: 'Rising targets, stalled reforms: Can Bangladesh deliver on FY26 export goals?'

বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছরই উচ্চাভিলাষী রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, কিন্তু বাস্তবে তা পূরণ হয় না। ২০২৬ অর্থবছরের জন্য ৬৩.৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৬.৫ শতাংশ বেশি। অথচ গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি এবং রপ্তানি বেড়েছিল মাত্র ৮.৫ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো বাস্তবসম্মত গবেষণা ছাড়াই নির্ধারণ করা হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকট, ব্যাংকিং জটিলতা, কাস্টমসে বিলম্ব, বন্দরজট এবং পরিবহন সমস্যার মতো দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সমাধান না হওয়ায় রপ্তানি বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে। 

ছোট রপ্তানিকারকদের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মতো উদ্যোগগুলো এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। এর ফলে কাঁচামাল আমদানি, কাস্টমস প্রক্রিয়া এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববাজারেও প্রতিযোগিতা বাড়ছে, যা রপ্তানি মূল্য কমিয়ে দিচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞরা এবং ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকার যদি এই মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দেয়, তাহলে বাংলাদেশ কেবল লক্ষ্য পূরনই নয়, বরং তার চেয়েও বেশি রপ্তানি করতে সক্ষম হবে।


নয়া দিগন্তের প্রধান শিরোনাম: 'সমীক্ষা ছাড়াই চলছে ২৭৬ কোটি টাকার ইলিশ প্ৰকল্প'

বাংলাদেশের জাতীয় মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে এবং এই খাতে পাঁচ লাখ মানুষ সরাসরি যুক্ত। এই গুরুত্বের কারণে সরকার ২০২০ সালে "ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প" হাতে নেয়। তবে, সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটি শুরু হওয়ায় নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২৪৬ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এই প্রকল্পের খরচ বেড়ে এখন ২৭৬ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এবং মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। 

পাঁচ বছরের মেয়াদ থাকলেও চার বছর দশ মাসে প্রকল্পের কাজ মাত্র ৫৭.৮৯ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, যা পরিকল্পনামাফিক কাজ না হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ইলিশ উৎপাদন ৬.২০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা, মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা এবং জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা। কিন্তু অভয়াশ্রমের সীমানা নির্ধারণ না করা, অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ না হওয়া এবং সর্বোপরি সমীক্ষা ছাড়াই পরিকল্পনা করায় প্রকল্পটি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। 

অতিরিক্ত আহরণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের কারণে ইলিশের উৎপাদন কমছে, যা জেলেদের জীবিকা এবং উপকূলীয় ইকোসিস্টেমকে হুমকির মুখে ফেলছে।


নিউ এজের প্রধান শিরোনাম: 'ACC reform gets stuck'

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কমিশন কর্তৃক জমা দেওয়া ৪৭টি সুপারিশের লক্ষ্য ছিল দুদককে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত করে আরও শক্তিশালী করা। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা দেওয়া, কমিশনারের সংখ্যা বৃদ্ধি, কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ করা এবং তদন্ত ও নীতিনির্ধারণে অগ্রাধিকার বাড়ানো। 

তবে, সরকার এই বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান এই স্থবিরতাকে হতাশাজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, দুদকের কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা এখনো রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট বাড়ছে। 

গত এক বছরে স্বেচ্ছায় মামলা প্রত্যাহারসহ বেশ কিছু ঘটনা দুদকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুদকের কাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে, যা সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।



মানবজমিনের প্রধান শিরোনাম: 'রাজশাহীতে ৪ জনের লাশ উদ্ধার, 'আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে'

রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে একটি মর্মান্তিক ঘটনায় এক পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতরা হলেন মিনারুল ইসলাম, তার স্ত্রী মনিরা খাতুন এবং তাদের দুই সন্তান মাহিম ও মিথিলা। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, মিনারুল আর্থিক সংকট এবং ঋণের বোঝা সইতে না পেরে তার স্ত্রী ও সন্তানদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর নিজে আত্মহত্যা করেছেন। 

ঘটনাস্থল থেকে একটি চিরকুটও উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে তিনি ঋণের দায় এবং খাদ্যের অভাবে এই চরম পথ বেছে নেওয়ার কথা লিখেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, একা মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পাবে, তাই তাদেরও সঙ্গে নিয়েছেন এবং এই ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী না করার অনুরোধ করেছেন। 

চিরকুটে মিনারুলের পরিবারের সদস্যদেরকে দাফনের খরচ বহন না করার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে। এই ঘটনাটি আমাদের সমাজে আর্থিক সংকট এবং হতাশার গভীর প্রভাবের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, তবে প্রাথমিকভাবে এটি একটি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড এবং আত্মহত্যা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।


দ্য ডেইলি স্টারের প্রধান শিরোনাম: 'Shahjalal International Airport Terminal-3: Operations face further delay'

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্যক্রম আবার বিলম্বিত হচ্ছে। এর কারণ হলো, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি। এই চুক্তির জন্য আরও এক-দুই মাস সময় লাগতে পারে, এবং জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের জন্য লাগবে আরও পাঁচ-ছয় মাস। ফলে, এই বছরের শেষ নাগাদ টার্মিনালটি চালুর নতুন সময়সীমাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

জাপানি কনসোর্টিয়াম (যেখানে জাপান এয়ারপোর্ট টার্মিনাল কোম্পানি, সুমিতোমো করপোরেশন, সোজিত্জ এবং নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করপোরেশন রয়েছে) টার্মিনালের সমস্ত অপারেশন পরিচালনা করবে, আর সিএএবি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। চুক্তি চূড়ান্ত না হওয়ার মূল কারণ হলো, রাজস্ব বণ্টন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এখনো সমঝোতা হয়নি। 

পোশাক রপ্তানিকারকদের মতো ব্যবসায়ীরা এই টার্মিনাল দ্রুত চালুর জন্য চাপ দিচ্ছেন, কারণ ভারতের ট্রানশিপমেন্ট বন্ধ করার পর থেকে রপ্তানি কার্যক্রমে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। টার্মিনালটি চালু হলে বছরে যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ২.৪ কোটি এবং কার্গো সক্ষমতা ১০ লাখ টনে উন্নীত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।


প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম: '৪ ধরনের অপরাধ বেশি, চ্যালেঞ্জ 'মব' নিয়ন্ত্রণ'

গত এক বছরে দেশে বড় ধরনের চারটি অপরাধ—খুন, ডাকাতি, অপহরণ এবং ধর্ষণ—উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নির্দেশ করে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুনের মামলা প্রায় চার হাজারে, ডাকাতির মামলা তিনগুণে এবং অপহরণের মামলা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও প্রায় ১৮ হাজার মামলার মাধ্যমে সামনে এসেছে। তবে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো 'মব' বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ, যেখানে গণপিটুনিতে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং এমনকি পুলিশের ওপরও হামলা হয়েছে। 

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এর পরবর্তী সহিংসতা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতার কারণ। তারা বলছেন, পুলিশের দুর্বলতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দক্ষ নেতৃত্বের অভাব মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। সরকার ও পুলিশ 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণের কথা বললেও পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

 নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের অপরাধ আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন এবং পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কঠোর পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন।


বণিক বার্তার প্রধান শিরোনাম: 'সংস্কারহীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পরবর্তী সরকারের জন্য হবে বড় বোঝা'

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বিশাল বকেয়া ছিল, যা অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করেছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু বকেয়া পরিশোধ করাই যথেষ্ট নয়, বরং এই খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য মৌলিক সংস্কার জরুরি। 

গত অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা এবং গ্যাস খাতে প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি এবং অব্যবস্থাপনা পরবর্তী সরকারের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। যদিও বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন বাতিল করা হয়েছে, তবে এর আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলো প্রকাশ না করায় স্বচ্ছতার অভাব রয়ে গেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতে সত্যিকারের সংস্কার মানে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা। যতক্ষণ না এই মৌলিক সংস্কারগুলো করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই খাতের সংকট কাটবে না।


ট্যাগসমূহ: বাংলাদেশ, সংবাদ বিশ্লেষণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ, শাহজালাল বিমানবন্দর, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, বণিক বার্তা, ডেইলি স্টার, মানবজমিন, সমকাল, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, নিউ এজ, নয়া দিগন্ত।

Post a Comment

Previous Post Next Post